আজ ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নিষ্ফলা বৃক্ষ-সুলেখা আক্তার শান্তা

জেরিনের বয়স নয় কিংবা দশ। এই বয়সে তার কাজকর্ম কিংবা কথা বলা কিংবা বুদ্ধিমত্তা দেখে মনে হয় সে বয়সের চেয়ে
অনেক বড়। জেরিনের বাবা-মা থাকে গ্রামে সে থাকে ঢাকায় খালার কাছে। খালা তাকে তেমন একটা আদর যত্ন করে না।
ছোট্ট জেরিন কাজে বিরক্তি প্রকাশ করলেও খালা নানান ফাইফরমাস দিয়ে তাকে ব্যস্ত রাখে। খালার ধমকের ভয়ে জেরিন
সব সময় আতঙ্কে থাকে। খালা পরে রাগারাগি করবে ভেবে জেরিন কখনো এসব মায়ের কাছে বলে না। তার খালা
আসমার সঙ্গে পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া জাহানারার খুব ভালো সম্পর্ক। অবসরে প্রায়ই আসমা গল্পগুজব করে তার সঙ্গে।
আসমা বেশ আবেগপ্রবণ মানুষ। তার একটা বড় গুন পরকে আপন করে নেওয়া। জেরিনের গুছিয়ে কাজকর্ম করা দেখে
জাহানারা খুব পছন্দ করে জেরিনের। একদিন মুখ ফুটে বলে, আসমা তোমার ভাগ্নিটা তো বেশ লক্ষী মেয়ে। কত সুন্দর
কাজ করে। ইশারা দিয়ে কাছে ডাকে, এই এদিকে আয়। আদর করে গালটা টিপে বলে, তোকে আমার খুব ভালো লাগে। তুই
আমাকে মা বলে ডাকবি? জেরিন যেন লজ্জা পায়। কী কিছু বলিস না যে? সে লাজুক একটা হাসি দেয়। বাহ! তোর
হাসিটাও তো বেশ চমৎকার। শোন, তুই আমাকে মা বলবি। আসমাকে বলে, তোমার ভাগ্নিটাকে দিয়ে দাও না আমাকে।
আসমা মনে মনে বিরক্ত হয়, কার মেয়ে আমি কাকে দেবো। কী বলো তুমি? তা কী করে সম্ভব? এতই যদি তোমার মায়া
লাগে আমরা তো পাশাপাশি আছি যখন ইচ্ছা তুমি দেখে যেও ওকে। জাহানারা বলে, তাতে কি মন ভরে। আমি চাই
সবসময়ের জন্য জেরিন আমার বাসায় থাক। আসমাকে আপাতত বিরত করার জন্য বলে, দেখি ভেবেচিন্তে তোমাকে
দেওয়া যায় কিনা! তুমি যত ভাবার ভাবো কিন্তু জেরিনকে আমাকে দিয়ে দাও। শেষে আসমা জেরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
শোন কী বলে, তোকে নিতে চায়, যাবি? ড্রয়িং রুম থেকে‌ দৌড় পালায় জেরিন। ভিতর রুমে চলে যায়। দেখছো না যাবে
না। যাওয়ার কথা কথা বলতেই কিভাবে দৌড়ে পালালো।
আসমা ছিল মোটাসোটা গড়নের। অনেক রোগ নাকি বাসা বেধেছিল। ওষুধ খেয়ে টিকে ছিল জীবন। অকস্মাৎ তাতে
যবনিকা নামে। হঠাৎ করে একদিন আসমার মৃত্যু হয়। সংসারের সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। কোথায় কার
কাছে থাকবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। স্থির হয় জেরিন দেশে চলে যাবে। জাহানারা জানতে পেরে এগিয়ে আসে।
বলে, এতটুকু মেয়ে। সেই কষ্টের মধ্যেই ওকে আবার ঠেলে দিচ্ছ। আমি ওকে রাখতে চাই। জেরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
আমার কাছে থাকবি তুই। জেরিন চুপ হয়ে থাকে। নীরবতা সম্মতি হয়ে যায়।
জাহানারার কাছে থাকতে থাকে জেরিন। তাকে মা বলে ডাকে। জেরিনকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সে দেখে তার
আদর যত্নের কমতি নাই। জাহানারার ছেলে মেয়েদের সঙ্গে অল্প দিনেই খুব ভাব হয়ে যায়। সমবয়সীদের তুলনায় তার
বিচার বুদ্ধি অনেক ভালো। কখনো কোন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে না। সমবয়সীদের চেয়ে বুদ্ধি বিবেচনায় সে অনেক
এগিয়ে। আপন পরের পার্থক্য সে এখন ভালোভাবে বুঝতে শিখেছে। অনুভব করে তার মা তাকে কতটা ভালোবাসে।
মমতায় আপ্লুত হয় সে। মায়ের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ জাগে। মা তুমি আমার রক্তের মা নয় তারপরও তুমি আমার মা।
তুমি আমাকে এত ভালবাসো। তাকে বিস্মিত করে কিছু বলার আগে অলক্ষে মায়ের কাছ থেকে সবকিছু পাওয়া।
জেরিন বড় হয়েছে।‌ জাহানারা তার আপন মা নয়। জাহানারা আপন মা না হলেও তার এক মুহূর্তেও মনে হয় না সে তার
আপন মা না। সব সময় তার কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছে পরিপূর্ণ। জাহানারার আরো তিন ছেলে মেয়ে রয়েছে।
কখনো মনে হয়নি কারো চেয়ে কাউকে কম বা বেশি ভালোবাসে। জাহানারার অপরের প্রতি মমত্ববোধ আর সহমর্মিতার
আদর্শ বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছে জেরিন। এমন একজন মহৎ মানুষ তার বুকে অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে। ‌জেরিন
ভাবে আপন মা না হয়েও তিনি যেভাবে আদর করেন জানিনা আপনের কাছ থেকে এত আদর পেতাম কিনা। সে প্রার্থনা
করে, আল্লাহ তাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখেন যেন সুস্থ সবল ভাবে বাঁচিয়ে রাখেন।‌
হারুন মামা প্রায়ই তাদের বাসায় আসে।‌ বাসায় এলে অনেকক্ষণ থাকে। হারুন জাহানারাকে বোন ডেকেছে সেই সম্পর্ক
নিয়ে বোনের বাসায় আসা। হারুন জাহানারার আপন ভাই না তা বুঝার কোন উপায় নাই। পরিবারের একজন সদস্য
হয়ে সে আপনার চেয়ে আপন হয়ে গেছে। হারুন মামা এলে বিরাট বাজার করে, খাওয়া দাওয়া করে, তারপর লম্বা এক ঘুম
দেয় তার নিজের ঘরে গিয়ে। জেরিন তাকে মামা বলে ডাকে। মামা জেরিনের জন্য কিছু দামি খাবার নিয়ে আসে। জেরিন

তুই এগুলো আমার সামনে বসে খা আমি দেখি। জেরিন বলে, মামা আপনি কী যে বলেন না আপনার পাগলামি আর মানা
যায় না। মামা পরে খাব। আমি বলছি এখনই খা। জেরিন হারুন মামার জোড়াজুড়িতে খাবারগুলো মুখে দেয়। হারুন
উৎফুল্ল হয়। এই যে তুই আমার চোখের সামনে বসে খাচ্ছিস এটা আমার খুব ভালো লাগছে। জাহানারা এতক্ষণ মামা
ভাগ্নির ঠেলাঠেলি দেখছিল। জেরিন তোর হারুন মামার পাগলামির শেষ নাই। এটা কখনো বন্ধ হবে না। দেখিস না যখন
যা বলে তাই করতে হয়। জেরিন অনুযোগ করে, মামা আপনার এই পাগলামি থামবে না কোনদিন। হারুন হেসে বলে,
কেন রে আমি কি তোদের সাথে বেশি পাগলামি করি? তা না। মামা আপনার এই পাগলামির মধ্যে একটা আদর আছে
অধিকার আছে। তাহলে বুঝেছিস কিন্তু দেরি করে বুঝেছিস।
একদিন জেরিন ড্রয়িং রুম গোছগাছ করছিল। কাজ শেষে হারুন মামার রুম গুছিয়ে দিতে সেখানে ঢুকে। আর সঙ্গে সঙ্গে
রুম থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে বেরিয়ে আসে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার সমস্ত বিশ্বাসের
ভিত প্রকম্পিত হয় প্রচন্ড ভূমিকম্পে। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে কন্ঠ। কিভাবে বিশ্বাস করবে মানুষ মানুষকে, কিভাবে মনে
সম্মানের স্থানে ঠাঁই দিবে। নাহ এটা আমি মেনে নিতে পারব না। ‌জেরিন সব গুছিয়ে বাসা থেকে বের হতে উদ্যত হয়।
জাহানারা বলে, মারে তুই আমাকে রেখে যাস না। জেরিন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তুমি আমাকে মা বলবা না আমি তোমার মেয়ে
না। আমি তোমার ব্যাপারে যা জেনেছি সব ভুল। কোন সন্তান তার মাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পারে না।‌ এতে তার
অহমিকা আত্মসম্মান জীবনের মর্যাদা বোধ নষ্ট হয়ে যায়। তোমার রূপ বাইরে এক ভিতরে আরেক। আমি কিছুতেই
মানতে পারছি না। আমাকে ধরবে না তুমি। আমি জানি তোর কাছে বড় মুখ করে কথা বলার মত আর আমার কিছুই
নাই। তুমি থাম। এই লোকের সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক আর তুমি আমাকে সেখানে রাখছো। থাকবো না আমি এখানে।
তাহলে শোন আমার কথা। কী শুনবো আমি তোমার কথা। তাহলে আমাকে ভুল বুঝেই থাকবি? তুমি যে ভুল করছো সেই
ভুলের সমাধান আছে? কোন সমাধান নেই। শোন মা আমার ব্যথার কথা। জেরিন কিছুটা সুস্থির হয়। কী বলবে বলো?
অবসন্ন জাহানারা শুরু করে। কী করে বলবো তোকে? ফাহিম, রিফাত, রিপা এরা কেউ আমার সন্তান না। তোর মতো
এদেরও আমি পালক এনেছি। কিন্তু কখনো কাউকে বুঝতে দেইনি আমি ওদের মা না। আমার সন্তান হয় না দেখে আমার
স্বামী আমাকে ফেলে চলে যায়। ডিভোর্সের পর অসহায় জীবন নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। এই যে হারুনকে দেখছিস এর
সাথে আমার কলেজ জীবনে প্রেম ছিল। কিন্তু দুই পরিবারে ছিল অসম্মতি তারা এই সম্পর্ক মেনে নেয় না। তখন অসহায়
অবস্থা গার্জিয়ানদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়। অভিভাবকদের পছন্দে আমার এবং হারুনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের
পর আমার স্বামী সন্তান হয় না দেখে আমাকে পরিত্যাগ করে। মা তোমার সব সন্তান এটা মানতে পারলেও আমি এটা
মানতে পারবো না। আমি তোমাকে মা জানি। তুমি ছিলে আমার গর্ব। মায়ের কোন খারাপ কোন সন্তানই মানতে পারে
না। মা যে সন্তানের একটা মসজিদ। তুমি সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিলে মা। জাহানারা তাকে থামায়। আগের সব কথা শোন
তারপর শুনবো তোর সিদ্ধান্তের কথা। জাহানারা খুলে বলে। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করে হারুনের সঙ্গে দেখা।
আলাপচারিতায় পুরনো সম্পর্ক আবার ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। আমি আপত্তি করি এভাবে চলতে পারে না। হারুন আমাকে বিয়ে
করে, আমি তার বৈধ স্ত্রী। পরিস্থিতি প্রয়োজনে অনেকেই দ্বিতীয় বিয়ে করে। দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহনের বিধান রয়েছে এটা কোন
অন্যায় নয়। আমি একটা নিষ্ফলা গাছ, ফলহীন বৃক্ষ। এ যে কী যন্ত্রণার জীবন তুই বুঝবি না। অসম্ভব হয়ে পড়েছিল
জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ানো। হারুনকে অবলম্বন করে আমি নীরবে নিভৃতে বাঁচতে চাইছিলাম। আমাদের বিয়ে হয়েছে
এটা কাউকে জানাতে চাইনি। ওতো আমাকে সবকিছু দিয়ে ভালই রেখেছে। ওর পরিবারকে জানিয়ে অহেতুক অশান্তি সৃষ্টি
করে কী লাভ! তারা ক্রমাগত একটা কষ্টের মধ্যে থাকবে। তাই আমাদের এই নীরবতা। এই দেখ আমার বিয়ের কাবিন।
যেখানে একজন সন্তান পালতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে চার চারটা সন্তান লালিত পালিত হচ্ছে। ওরা আমাকে মা বলে
ডাকে। আমার সুখের জন্য ও এই ব্যবস্থা করেছে।
জেরিন মায়ের পা জড়িয়ে ধরে, মা তুমি আমাকে ভুল বুঝনা আমাকে মাফ করে দাও। আজ তুমি এটা খোলাসা করে না
বললে তোমার প্রতি আমার প্রচন্ড অভিমানে হয়তো আমার জীবনের গতিপথ বদলে যেত। মা তুমি সমস্ত ভুলের অবসান
করে দিয়েছো। তুমি আমার মা তুমি যে আমার মা। জাহানারাও জেরিনকে বুকে জড়িয়ে নেয়। যে সত্য এতদিন লুকিয়ে
রেখেছিলাম আজ তোদের কাছে বলতে পেরে আমি হালকা হয়েছি। তাদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ